সরকারি নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে অভিযুক্ত মাহবুবা নাসরিন রুপা। ছাত্রলীগ থেকে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। পরে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হয়েছেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানও। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার মেয়ে রুপা এখন সবার আলোচনার বিষয়।
ভর্তি পরীক্ষা ও সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিন রুপা গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যরা তাঁকে ঢাকা থেকে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীনে ‘অডিটর’ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী মাহবুবা নাসরিন রুপাকে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। রবিবার দুপুরে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আল রাজি জুয়েল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার এবং দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় মাহবুবা নাসরিন রুপার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
মাহবুবা নাসরিন রুপা বগুড়া জেলা ও দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি দুপচাঁচিয়া উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার ভুঁইপুর গ্রামের মৃত আতাউর রহমানের মেয়ে।
এ ঘটনার পর তাঁর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁরা বাবা আতাউর রহমান ঢাকাতেই দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি অফিসের নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করতেন। অখ্যাত পরিবারের এ মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেষ করে বাবার ঢাকায় অবস্থানের সুবাদে তিনি ঢাকায় মাধ্যমিক ও কলেজে পড়াশুনা করেন।
মাহবুবা নাসরিন রুপা ইডেন কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের দাপুটে নেত্রী ছিলেন। প্রথমে কলেজ ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার সময় হলের সিট-বাণিজ্য ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করারও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (মাস্টার্স) অর্জনের পর বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি হঠাৎ করেই ঢাকা থেকে দুপচাঁচিয়ায় এসে ১৪ দল মনোনীত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগে নামেন। পরে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হওয়ার পর এলাকায় তাঁর পরিচিতি প্রকাশ পায়।
ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয়ে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে মাঠে নামেন। সরকারি দলের পরিচয় দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন নারী প্রার্থীকে ডিঙিয়ে তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
নির্বাচিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর বাবা মারা যান। তারপর শুরু হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের নেত্রী হয়ে বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর দাপট। নির্বাচনে জিতে শপথ গ্রহণের পর উপজেলা পরিষদের প্রথম বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ইশারায় উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ভুঁইপুর গ্রামে না থেকে তাঁর বড় বাবা (চাচা) দেলোয়ার হোসেনের গোবিন্দপুরের পালিমহেশপুর গ্রামে থাকতেন। চাচার বাড়িতে থেকেই তিনি আপন ভাই রকিবুল হাসান রকিকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সদস্য বলেন, রুপার হস্তক্ষেপেই তখন হাইব্রিড নেতাদের নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি করা হয়েছে।
রূপার বড় চাচা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন মুঠোফোনে জানান, তার ভাতিজির নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়াশুনার সময় ঢাকার জিরানি বাজার এলাকায় একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। বাবা-মা না থাকায় এবং ছোট বোন শিউলী স্বামীর বাড়িতে এবং ছোট ভাই রকি ঢাকায় লেখাপড়ার কারণে মাঝে মধ্যেই রূপা তার বাসায় অবস্থান করতো। তার বিষয়ে খারাপ কোনো কিছুই আমি আগে শুনেননি বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, কমিটির প্রাথমিক সদস্য পদে রুপার নাম ছিল, কিন্তু চূড়ান্ত কমিটিতে তাঁর কোনো সদস্য পদ নেই।
তিনি আরো বলেন, অপরাধ যেই করুক না কেন দল কোনো দায়িত্ব নিবে না।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান বলেন, মাহবুবা জেলা আওয়ামী লীগ এবং দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিল। রবিবার তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
তাকে গ্রেপ্তারের পর ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, মাহবুবা নাসরিন প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। নিয়োগের কথা বলে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন তিনিসহ কয়েকজন। ‘
তিনি আরো বলেন, প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য শুক্রবার ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ডিবির গুলশান বিভাগ তথ্য পায়-চক্রের সদস্যরাই পরীক্ষার্থী সেজে কেন্দ্রে ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে যায়। প্রশ্নপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে তারা ডিভাইসের মাধ্যমে চক্রের অপর সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাইরে থেকে তারা প্রশ্ন সমাধান পাঠিয়ে দেয় কেন্দ্রে। চাকরি প্রার্থীদের এভাবেই তার পাস করাতেন তারা। এর জন্য প্রতি চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা নিতেন। অগ্রিম হিসেবে নেওয়া হত দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা।
তথ্যসূত্র : কালের কন্ঠ
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।